শহীদ মীর নিসার আলী তিতুমীর (২৭ জানুয়ারি ১৭৮২ – ১৯ নভেম্বর ১৮৩১)


এম.কে.জাকির হোসাইন বিপ্লবী

মীর নিসার আলী, যিনি তিতুমীর নামে পরিচিত, ছিলেন উপমহাদেশের স্বাধীনতার এক অনন্য প্রতীক। ১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মীর হাশিম ছিলেন একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিতুমীর ধর্মীয় অনুশাসন এবং নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করেন।

**প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা**
তিতুমীর শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলেন। ধর্মীয় এবং প্রথাগত জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি তিনি আরবী, ফার্সি এবং উর্দু ভাষায় দক্ষতা লাভ করেন। তাঁর চিন্তাভাবনার ভিত্তি ছিল ইসলামি শাসনব্যবস্থার ন্যায়বিচার এবং সামাজিক সমতা। এ সময় তিনি বাংলার কৃষকদের ওপর জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে সচেতন হতে শুরু করেন।

**সামাজিক ও ধর্মীয় পুনর্জাগরণ**
তিতুমীর ইসলামের মূল শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি দেখেন, ব্রিটিশ শাসক এবং স্থানীয় জমিদাররা সাধারণ মানুষের ওপর চরম শোষণ চালাচ্ছে। তিনি কেবল একটি রাজনৈতিক সংগ্রামের নেতা ছিলেন না, বরং সামাজিক ও ধর্মীয় পুনর্জাগরণেও ভূমিকা রাখেন।

**সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর প্রভাব**
তিতুমীর তাঁর সংগ্রামের নীতি ও আদর্শে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর আদর্শকে গ্রহণ করেন। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর নেতৃত্বে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ব্রিটিশবিরোধী জিহাদ পরিচালিত হচ্ছিল। তিতুমীরও একইভাবে বাংলার মাটিতে ইংরেজ শাসন এবং তাদের দোসর জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

**তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা**
ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে তিতুমীরের সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ১৮৩১ সালে নির্মিত বাঁশের কেল্লা। এটি ছিল নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে একটি প্রতিরক্ষা কেল্লা, যা তিতুমীর ও তাঁর অনুসারীদের জন্য একটি প্রতীকী দুর্গ ছিল। বাঁশের কেল্লার স্থাপত্য ও শক্তি ইংরেজদের কাছে এতটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় যে তারা এই প্রতিরোধ দমনে সেনা পাঠায়।

**ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম**
তিতুমীরের নেতৃত্বে স্থানীয় কৃষক ও সাধারণ মানুষ সংগঠিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তিনি সামাজিক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁর সংগ্রামে হিন্দু-মুসলমান উভয়ই অংশ নেন।

১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ব্রিটিশ সেনারা তাঁর বাঁশের কেল্লায় আক্রমণ চালায়। কেল্লার প্রতিরক্ষা ভেঙে ফেলতে তারা কামান ব্যবহার করে। এই যুদ্ধে তিতুমীর এবং তাঁর অনেক সহযোগী শাহাদাতবরণ করেন।

**তিতুমীরের উত্তরাধিকার**
তিতুমীরের জীবন কেবল একটি রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস নয়, বরং এটি ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণেরও গল্প। তাঁর সংগ্রাম ভবিষ্যতের স্বাধীনতাকামী নেতাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে আছে। আজও তিনি বাংলার প্রতিটি সংগ্রামী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন।

তাঁর শাহাদাত শুধু একটি যোদ্ধার মৃত্যুই নয়, এটি ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার এক অনন্ত প্রেরণা। “তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা” আজও ইতিহাসে একটি সাহসী অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।