যশোরের চাঁচড়ার মোড়ে পথসভা: কেউ যেন ফাঁকতালে ঢুকে আমাদের জাতীয় ঐক্য নষ্ট করতে না পারে – ডা. শফিকুর রহমান



নিজস্ব প্রতিবেদক
যশোর বিমানবন্দরে নেতাকর্মীদের সংবর্ধনা

বেলা তখন ৬টা ২৫ মিনিট। মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে মাত্র। যশোর বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার দরজার সামনে প্রখর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে কতগুলো চোখ। পরিচিতি দেখে মনে হয়েছে তাদের অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না। নয়নের আলো চারদিকে ঝলমল করছে। এমন সময় বিমানবন্দরের দরজার সামনে এলেন সাদা চুল-দাঁড়ি যুক্ত সফেদ পায়জামা এবং পাঞ্জাবি পরিহিত একজন মানুষ। তিনি আর কেউ নন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। তার অপেক্ষাতেই ছিলেন যশোরের কয়েক হাজার নেতাকর্মী। প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখার জন্যই এই অপেক্ষা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি মিষ্টি শীতের শুভেচ্ছা জানিয়ে মাঠে ময়দানে দেখা হওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

ঢাকা থেকে বিমান যোগে আসা আমীরে জামায়াতকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন যশোর জেলার আমীর অধ্যাপক গোলাম রসুলের নেতৃত্বে একদল নেতাকর্মী। এ সময় আমীরে জামায়াতের সফর সঙ্গী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন। বিমান থেকে নেমে জামায়াতে ইসলামীর আমীর গাড়িতে উঠেন। তিনি বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে নেতাকর্মীদের অভিবাদন জানাতে জানাতে শহরের দিকে রওয়ানা হন। রাস্তায় তিনি প্রথম পথসভায় বক্তব্য রাখেন যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ এই চারটি জেলার সংযোগস্থল চাঁচড়া চেকপোস্ট মোড়ে। তিনি বলেন, এই মোড়ে নতুন মুক্ত বাংলাদেশে বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো দলীয় প্রধান হিসেবে জামায়াতের আমীরের এটাই প্রথম আগমন।

প্রথম পথসভায় উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “যশোর মিষ্টি গুড় আর মিষ্টি শীতের শুভেচ্ছা। আত্মীয় স্বজনকে সবরে ছানি দান করুন। দোয়া করি আমার ভাই আবদুল্লাহসহ যারা জীবন দিয়েছেন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করেন। তাদের উছিলায় বাংলাদেশের মানুষের ওপর শান্তি বর্ষণ করুন। আমি বিশেষভাবে স্মরণ করছি যারা ২৪ এর স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তাদের মূল্যবান জীবন বাজি রেখেছেন। এই সংগ্রামে এবং আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান এবং বিপ্লবে আপনারাও লড়াই করেছেন। আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের সন্তানেরা একটি বৈষম্যহীন সমাজের জন্য গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। আমরাও সেই বৈষম্যহীন দেশ গড়ে তুলতে চাই। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে মানুষের মধ্যে জাতপাত, দল, ধর্মের ব্যবধান থাকবে না। সমস্ত মানুষ তার সকল বৈধ অধিকার ভোগ করবে।”

তিনি আরও বলেন, “শ্রমিক তার অধিকার ভোগ করবে। কৃষক তার অধিকার পাবে। সে তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবে। আবার অফিস আদালত কোর্ট কাচারিতে যারা কাজ করেন, তারা জনগণের আমানতের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবেন। অফিস আদালতে কোনো ঘুষ দুর্নীতি থাকবে না ইনশাআল্লাহ। ২০২৪ সালের এই যুদ্ধে কোলের শিশুরা শহীদ হয়েছে। বৃদ্ধরা শাহাদাত বরণ করেছে। তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরাও লড়াই করেছি। আমাদের এই জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হবে। কেউ যেন ফাঁকতালে ঢুকে এই ঐক্য নষ্ট না করতে পারে। এজন্য আপামর ছাত্র-জনতাকে এবং সমস্ত বাংলাদেশের মানুষকে সজাগ থাকতে হবে। যারা আমাদের ওপর ফ্যাসিবাদের ডালপালা বিস্তার করেছিলেন, এক নাগাড়ে ১৫ বছর যারা তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, যারা খুন গুম চালিয়েছিলেন, দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করেছেন, আমরা তাদের ক্ষমা করবো না। তাদের প্রত্যেকের বিচার করা হবে।”

জামায়াতের আমীর বলেন, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি মজলুম দল। এই দলের শীর্ষ নেতাকে বিচারের নামে হত্যা করা হয়েছে। কোরআনের পাখি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাহিমাহুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা গোলাম আজম রাহিমাহুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করা হয়েছে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে। হত্যা করা হয়েছে আপনাদের কৃতি সন্তান জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে। হত্যা করা হয়েছে আবদুল কাদের মোল্লাকে, হত্যা করা হয়েছে আমার ভাই কামারুজ্জামানকে। বাংলাদেশের সর্বত্র কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমাদের বৈধ অফিসে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আমাদের দলকে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহর ফয়সালা ভিন্ন ছিল। যারা এই বাংলার জমি থেকে ইসলামী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র শিবিরকে চিরতরে নির্মূল করতে চেয়েছিল, রাব্বুল আলামিন আজ তাদের নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এটা আমাদের কোনো কৃতিত্ব নয়, সমস্ত কৃতিত্ব আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের। আমরা আমাদের কর্মীকে বলেছিলাম আপনারা উল্লাস করবেন না। কারো ওপর হাত তুলবেন না। তারা আমাদের কথা রেখেছিল। আমাদের সহকর্মীদের ওপর এত নির্যাতন করা হয়েছে। আমাদের অন্তরে অনেক কষ্ট।”

তিনি আরও বলেন, “যশোর ঐতিহ্যবাহী এবং আন্দোলন-সংগ্রামের এলাকা। সুদীর্ঘ সংগ্রামের এলাকা। এই এলাকা থেকে সর্বপ্রথম একটি দেশের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ৯ম ডিভিশনের সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম এ জলিল সঙ্গীদের নিয়ে লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাই এই যশোরকে আমরা অনন্য উচ্চতায় দেখি।”

এরপর দ্বিতীয় পথসভা করেন যশোর বেনাপোল মহাসড়কের ঝিকরগাছা বাজার এলাকায়। সব শেষে তিনি পথসভায় বক্তব্য রাখেন শার্শা উপজেলার নাবারুণ মোড়ে। সভা শেষে রাতেই তিনি রওয়ানা দেন সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে।